কী আছে ভারতের নয়া নাগরিকত্ব আইনে?

নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিরুদ্ধে পুরো ভারতজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। কী আছে এই আইনে, আর তার জেরে কেনই বা বিক্ষোভ ছড়াচ্ছে দিকে দিকে? নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা ক্যাব রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাবার পর আইনে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু নতুন এই নাগরিকত্ব আইন আসাম চুক্তির পরিপন্থী বলে দাবি উঠেছে। মূলত এরপর থেকেই আসামে ব্যাপক গণ্ডগোল শুরু হয়েছে ক্যাবের বিরুদ্ধে। কারফিউ, সেনা, আধাসেনায় গুয়াহাটি থেকে ডিব্রুগড় কম্পমান।

পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি বিজেপি কতৃত্বহীন রাজ্য নতুন নাগরিকত্ব আইন মানবে না বলে জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে এ আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পিটিশনও ফাইল করা হয়েছে। সরকার এই পরিবর্তিত আইনকে সহানুভূতিশীল বলে দাবি করা সত্ত্বেও কেন একে মুসলিম বিরোধী ও অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করা হচ্ছে এবং এত তীব্র প্রতিক্রিয়া কেন হচ্ছে একবার দেখে নেয়া যাক।

আসামে এত কঠোর বিরোধিতা হচ্ছে কেন?
আসামের বিরোধিতার কারণ নয়া আইনে কারা বাদ পড়ছেন সে নিয়ে নয়, কতজন অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পাচ্ছেন সেটা নিয়ে। আন্দোলনকারীদের আশঙ্কা- এর ফলে আরও বেশি অভিবাসী এ রাজ্যে এসে পৌঁছবেন। এ রাজ্যের জনবিন্যাস এবং রাজনীতি অভিবাসন দ্বারাই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। ১৯৭৯-৮৫ সালের আসাম আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনকে কেন্দ্র করে।

অনেক আসামীয় (অসমিয়) আন্দোলনকারীদের দাবি, নতুন আইন ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি ভঙ্গ করছে। আসাম চুক্তিতে ভারতীয় নাগরিকত্বের ভিত্তি দিবস ধরা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। আসাম এনআরসি-র ভিত্তিদিবসও ছিল ওই দিনই, যে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা এ বছর প্রকাশিত হয়েছে। নতুন আইনানুসারে, ভিত্তিদিবস ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, পারসি, খ্রিষ্টান, জৈন ও শিখদের জন্য এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। মুসলিমদের বাদ দেয়ার কারণে এই আইন বিতর্কিত হয়ে উঠেছে।

পুরনো আইনে এই গোষ্ঠীভুক্তরা কীভাবে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারতেন?
সংবিধানের ৬নং অনুচ্ছেদে পাকিস্তান (যার কিয়দংশ বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আসা একজন অভিবাসী যদি ১৯৪৮ সালের ১৯ জুনের আগে ভারতে আসতেন, তবে তাকে নাগরিকত্ব দেয়া হত। আসাম, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বহু সংখ্যক অভিবাসী এসেছেন, সেখানে এমন অভিবাসীদের আসাম চুক্তিতে উল্লিখিত ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখের আগে প্রবেশ করলে নাগরিকত্ব দেয়া হবে।

বেআইনি অভিবাসী প্রসঙ্গে ভারতে আশ্রয় দেয়া বা শরণার্থী স্বীকৃতি দেবার কোনও নির্দিষ্ট জাতীয় নীতি নেই। তবে যেসব বিদেশি নাগরিক নিজেদের উদ্বাস্তু বলে দাবি করেন, তাদের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একটা সাধারণ পদ্ধতি রয়েছে। সরকার তাদের হয় ওয়ার্ক পারমিট দেয় অথবা দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দেয়। সাম্প্রতিক সংশোধনীর আগ পর্যন্ত সংখ্যালঘু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবার ব্যাপারে নাগরিকত্ব আইনে কোনও বিধি ছিল না।

অন্যদের জন্য নাগরিকত্ব আইন কী?
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, ভারতের নাগরিকত্বের চারটি পদ্ধতি রয়েছে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব- ১৯৫৫ সালে আইনে বলা হয়েছিল ১০৫০ সালের ১ জানুয়ারি বা তার পর ভারতে জন্মগ্রহণ করলেই ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হওয়া যাবে। পরে আইনে সংশোধন আনা হয়। স্থির হয়, ১ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১ জানুয়ারি, ১৯৮৭ সালের মধ্যে ভারতে জন্মালেই ভারতের নাগরিক বলে গণ্য।

২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনা হয়। বলা হয়, ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর যিনি ভারতে জন্মেছেন তার বাবা-মায়ের কেউ একজন যদি ভারতীয় হন এবং অন্যজন বেআইনি অভিবাসী না হন, তাহলে ওই ব্যক্তি ভারতের নাগরিক হবার যোগ্য। অর্থাৎ, ২০০৪ সালের পর ভারতে জন্মগ্রহণ করা কারও বাবা বা মায়ের কেউ একজন যদি বেআইনি অভিবাসী হন, তাহলে ওই ব্যক্তি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হতে পারছেন না।

আইনে বলা হয়েছে, অবৈধ অভিবাসী হলেন এমন বিদেশি যিনি (১) ভ্রমণের বৈধ নথি, যথা পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়া প্রবেশ করেছেন, অথবা, (২) বৈধ নথি নিয়ে প্রবেশ করেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়েও বসবাস করেছেন।

উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিক- ভারতের বাইরে জন্মানো কোনও ব্যক্তির বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ একজন ভারতীয় হলে এবং ওই জন্মগ্রহণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ভারতীয় দূতাবাসে নথিভুক্ত করা হলে ওই ব্যক্তি নাগরিকত্ব প্রাপ্তির যোগ্য। নথিভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্ব- বিবাহসূত্রে বা বংশানুক্রমিকতার জেরে নাগরিকত্বের নথিভুক্তির জন্য এটি প্রয়োজনীয়।

স্বাভাবিক নাগরিকত্ব- নাগরিকত্ব আইনের ৬নং ধারায় বলা হয়েছে কোনও ব্যক্তি যদি অবৈধ অভিবাসী না হন এবং দরখাস্ত করার আগে টানা ১২ মাস ভারতে বাস করেন, তাহলে তাকে স্বাভাবিকতার প্রশংসাপত্র দেয়া হবে। এছাড়া, এই ১২ মাস সময়ের আগে ১৪ বছরের মধ্যে অন্তত ১১ বছর তাকে আবশ্যিক ভাবে ভারতবাসী হতে হবে (নয়া আইনে এই সময়কাল বিশেষ গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে ৫ বছর ধার্য করা হয়েছে)।

এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার যদি মনে করে, আবেদনকারী বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, বিশ্বশান্তি বা মানুষের উন্নতির জন্য দারুণ কাজ করেছেন, তাহলে উপরোক্ট বিধিগুলির সবকটি বা কোনও একটি থেকে তাঁকে ছাড় দিতে পারে। এ ভাবেই দলাই লামা বা পাকিস্তানি গায়ক আদনান সামি ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছেন।

নতুন আইনে কতজনকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়া যেতে পারে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এই সংশোধনীর ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের লাখ লাখ কোটি কোটি অমুসলিমরা উপকৃত হবেন। ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের হিসেবে সরকারি হিসেবে ভারতে মোট ২ লাখ ৮৯ হাজার৩৯৪ জন রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি রয়েছেন। ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় লোকসভায় এই তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ৩ হাজার ৮১৭ জন। এরপর রয়েছে শ্রীলঙ্কার, ১ লাখ ২ হাজার ৪৬৭ জন। এরপর তিব্বত (৫৮,১৫৫), মিয়ানমার (১২,৪৩৪), পাকিস্তান (৮৭৯৯) এবং আফগানিস্তান (৩,৪৬৯)। রাষ্ট্রহীন এই নাগরিকদের হিসেব ধর্মভেদে করা হয়নি।

২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর যারা নিয়মিত পথে ভারতে এসেছেন তারা আবেদন করবেন। যদি তারা অবৈধ অভিবাসী বলে চিহ্নিত হন, তাহলে তারা স্বাভাবিক নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন না, তা সে যে ধর্মেরই হোন না কেন।

যেসব সম্প্রদায়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তারা কি ওই তিন দেশে আদৌ নিপীড়িত?
রাজ্যসভায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের প্রমাণ হিসেবে সংবাদ প্রতিবেদনে ভরসা করেছেন। এর মধ্যে জোর করে ধর্মান্তরণ থেকে মন্দির ধ্বংস সবই রয়েছে। উল্লেখযোগ্য উদাহরণ- পাকিস্তানের খ্রিষ্টান মহিলা আসিয়া বিবি, যাকে ধর্মনিন্দার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ৮ বছর জেলে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষার পর পাক সুপ্রিম কোর্ট তাকে মুক্তি দেয়।

বাংলাদেশে ইসলামিক জঙ্গিদের হাতে নাস্তিক হত্যার বহু তথ্য রয়েছে। অমিত শাহের দাবি, শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর থেকেই সে দেশে নিপীড়ন চলছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অমিত শাহ যদিও অমুসলিমদের নিপীড়িত সংখ্যালঘু বলে উল্লেখ করেছেন, তবে আইনের বয়ানে অবশ্য নিপীড়ন শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

আইনগত দিক থেকে এবং সাংবিধানিকভাবে এই আইন বিতর্কিত কেন?
আইন বিশেষজ্ঞ এবং বিরোধী নেতারা বলছেন, এই নয়া আইন সংবিধানের মর্মবস্তু এবং তার লিখিত বস্তু উভয়কেই লঙ্ঘন করেছে। সংসদে একবার বলা হয়েছে, এই আইন সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে যে সকলকে সমানভাবে সুরক্ষা দেবার কথা বলা রয়েছে, তাকে লঙ্ঘন করছে।

দ্বিতীয়ত এই আইনের উদ্দেশ্য বিধেয় এক হওয়া প্রয়োজন। যদি এরকমভাবে ভাগ করতেই হয়, তাহলেও কারা ওই ভাগের আওতায় আসবেন, সে ব্যাপারে সমতা প্রয়োজন। যদি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়াই এ আইনের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কিছু দেশকে বাদ দেয়া এবং ধর্মকে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত সাফল্য নাও অর্জন করতে পারে।

এছাড়াও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে পারে, যে প্রকৃতি সংবিধানের ভিত্তি এবং তা সংসদ পাল্টাতে পারে না। অমিত শাহের যুক্তি, তিন প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান- যে দেশগুলোর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, এই তিন দেশের সংখ্যালঘুরা গ্রহণযোগ্য হতে পারেন।

আরেকটি যুক্তি হল- আইন অনুসারে অন্য দেশ থেকে আসা অন্য গোষ্ঠীর অভিবাসীদের কথা এই আইনে বলা নেই। আইন তো কেবলমাত্র অভারতীয় মুসলিমদের বাদ রাখছে, তাহলে এ আইনকে ভারতীয় মুসলিমবিরোধী আইন বলা হচ্ছে কেন?

সরাসরি এ সংশোধনীতে ভারতীয় নাগরিকদের বাদ দেয়ার কথা বলা নেই। তবে আসামের এনআরসি এবং নতুন নাগরিকত্ব আইন আলাদা করে দেখা যাবে না। চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে ১৯ লাখের নাম বাদ পড়েছে। নতুন আইন বাঙালি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়ার একটা সুযোগ দিচ্ছে, কিন্তু সে সুযোগ পাচ্ছেন না মুসলমানরা। তাদের আইনি পথে লড়তে হবে।

অমিত শাহ এবং বিজেপি নেতারা বলছেন, আসামের এনআরসি পদ্ধতি সারাদেশে লাগু করা হবে। এর ফলে ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে আশঙ্কার পরিবেশ দেখা দিয়েছে।

রাজনৈতিক দিক থেকে, এই আইনের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ভোট হবে ২০২১ সালে।

অন্য গোষ্ঠী কারা?
মিয়ানমারের নিপীড়িতদের (রোহিঙ্গা মুসলিম) কথা এই আইনে নেই, নেই শ্রীলঙ্কার তামিলদের কথাও। অমিত শাহ বারবার বলেছেন, একজন রোহিঙ্গা মুসলিমকেও ভারতে আশ্রয় দেয়া হবে না। এছাড়া পাকিস্তানে নিপীড়িত শিয়া ও আহমেদিয়া মুসলিম বা আফগান তালিবানদের হাতে নিপীড়িত হজরা, তাজিক এবং উজবেকদের অনুমতি না দেয়ার ফলে এই আইন ১৪নং অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের দায়ে পড়তে পারে। সংসদে অমিত শাহের যুক্তি ছিল- ইসলামিক দেশে মুসলিমরা নিপীড়িত হতেই পারেন না।

পাকিস্তানের শিয়া ও আহমেদিয়াদের বাদ দেয়ার প্রসঙ্গের সপক্ষে বিজেপি সাংসদ সুব্রামনিয়ন স্বামী বলেছেন, নিপীড়িত কোনও শিয়া ভারতে না এসে ইরান যাবেন।

শ্রীলঙ্কা এবং ভূটানের বিষয়ে অমিত শাহের যুক্তি, এ দুটি দেশের কোনওটিতেই ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম নয়। ঘটনাচক্রে ভূটান ও শ্রীলঙ্কা দুদেশেই রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়া আছে।

এগুলো কি নিপীড়িত গোষ্ঠী?
পাকিস্তানের দ্বিতীয় সাংবিধানিক সংশোধনীতে আহমেদিয়াদের অমুসলিম বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আহমেদিয়ারা নিজেদের মুসলিম বললে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা হবে। আহমেদিয়াদের ভোটদানের অধিকারও নেই।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতার মার্কিন কমিশন পাকিস্তানকে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী দেশের তালিকার উপর দিকে রেখেছিল। এ বছরের অগাস্টে আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, চীন ও পাকিস্তানে ধর্মীয় নিপীড়নের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সারা দেশে এনআরসি চালু হলে হিন্দুদের নামও কি বাদ পড়বে না?

হিন্দুদের বাদ পড়বার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নাগরিকত্ব আইন এধরনের হিন্দুদের সুরক্ষাকবচ হিসেবে দেখা দেবে। অমিত শাহ সংসদে বলেন, নাগরিকত্বের আবেদনের সময়ে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে কোনও রকম নিপীড়নের প্রমাণপত্র চাওয়া হবে না।

কংগ্রেস নেতা কপিল সিবাল রাজ্যসভায় বলেছেন, আসামের এনআরসি থেকে বাদ পড়া কোনও হিন্দু যদি নতুন আইনে নাগরিকত্বের আবেদন করেন, তার অর্থ কার্যত তিনি মিথ্যাচার করবেন। এনআরসি প্রক্রিয়ায় ওই ব্যক্তি নিজের ভারতীয়ত্বের প্রমাণপত্র জমা দিয়েছিলেন। এখন তিনি যদি নাগরিকত্বের আবেদন করেন, তার মানে তাকে বলতে হবে যে তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য পালিয়ে এসেছেন।

এদিকে, এনআরসি প্রক্রিয়ার জন্য আসামে খরচ হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং গোটা প্রক্রিয়ায় কয়েক বছর লেগেছে। ফলে গোটা ভারতে এ প্রক্রিয়ার জন্য কত সময় ও খরচ লাগতে পারে তা অননুমেয়। আসামে এনআরসির পক্ষে রাজনৈতিক সহমত ও জনমত ছিল। অন্যদিকে সারা ভারতে তা লাগু করতে হলে রাজনৈতিক দল, সরকার, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রতিরোধ আসবেই।

অমিত শাহ বলেছেন, এই আইন ১৯৫০ সালের নেহরু-লিয়াকত চুক্তির ভ্রম সংশোধন। তাহলে, কী ছিল ওই চুক্তিতে?

দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জেরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা দিল্লি চুক্তি নামে সমধিক পরিচিত। দুই দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার সম্পর্কিত এই বিষয় মাথায় রেখে এই চুক্তি হয়। অমিত শাহের দাবি, ভারত তাদের দিক থেকে এই চুক্তি রক্ষা করলেও পাকিস্তান তাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং নতুন আইন এই ভুল সংশোধন করবে।

কয়েকটি রাজ্য এ আইন প্রয়োগ করবে না বলেছে। তারা কি এমনটা করতে সক্ষম? বিভিন্ন রাজ্যে অবিজেপি শাসক দল এটিকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে ধরছে। উত্তর পূর্বের প্রায় সব রাজ্যই এই আইন থেকে ইনার লাইন পারমিট বা ষষ্ঠ তফশিলের জেরে ছাড় পাচ্ছে।

আসামের কতটা জায়গা ছাড় পাচ্ছে?
আসামে তিনটি স্বায়ত্তশাসিত জেলাকে নতুন আইনের আওতা থেকে বাদ রাখা হয়েছে। এতে আরেকটা প্রশ্নও উঠছে। এক রাজ্যে দুটি নাগরিকত্ব আইন কিভাবে চলতে পারে?

আসাম চুক্তির ৫.৮ ধারা অনুসারে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বা তার পরে যে সব বিদেশি আসামে এসেছেন, তাদের চিহ্নিত করে, নির্মূল করা হবে এবং এদের বহিষ্কার করার উদ্দেশ্যে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আসাম চুক্তি কী এবং সেখান থেকে কীভাবে এনআরসি হল?
১৯৮৫ সালের ১৫ অগাস্ট আসাম চুক্তি সই হয়। চুক্তি সই করেছিল ভারত সরকার, আসাম সরকার, সারা আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং সারা আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবসানের বিরুদ্ধে ৬ বছরের গণ আন্দোলন সমাপ্ত হয়েছিল এই চুক্তির জেরে।

১৯৮৩ সালের একটি আইন, যা কেবলমাত্র আসামে প্রযোজ্য সেখানে বিদেশি চিহ্নিত করার পদ্ধতি বর্ণনা করা রয়েছে। ২০০৫ সালে, ওই আইন সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক বলে বর্ণনা করে। আবেদনকারী সর্বানন্দ সান্যাল (বর্তমান আসামের মুখ্যমন্ত্রী) বলেছিলেন, এই আইন এতটাই কঠোর যে, এর ফলে বেআইনি অভিবাসী চিহ্নিত করা এবং তাদের ফেরত পাঠানোর কাজ প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে। আসাম পাবলিক ওয়ার্কস নামের এক এনজিও ভোটার তালিকা থেকে বিদেশি অভিবাসীদের নাম বাদ দেবার।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, আসাম চুক্তির ৬নং ধারা অনুযায়ী আসামের সংস্কৃতি সুরক্ষিত থাকবে। এ ব্যাপারটা কী?

আসাম চুক্তিতে এ বিষয়টি ভারসাম্যের কারণে আনা হয়েছিল। অন্য সব জায়গায় পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে নাগরিকত্বপ্রাপ্তির ভিত্তিদিবস ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাই, কিন্তু আসামের ক্ষেত্রে তা ২৪ মার্চ ১৯৭১। অতিরিক্ত এই ইভিবাসনের কারণে ৬নং ধারায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, অসমিয়া মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ভাষিক পরিচয় ও ঐতিহ্য সুরক্ষিত রাখবার জন্য এবং তাকে তুলে ধরবার জন্য সাংবিধানিক প্রশাসনিক ও আইনি সুরক্ষাকবচ দেয়া হবে।

এই সুরক্ষা দেয়া হবে নাগরিকত্ব আইনের ৬নং ধারায়। যার ফলে, আসাম চুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রাপ্তির বিশেষ বিধি তৈরি হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে ৬নং ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।

কারা অসমিয়া নাগরিক বলে নির্দিষ্ট হবেন, তার কোনও সংজ্ঞা এখনও নির্ধারিত হয়নি। একটা চালু মত হল, অন্তত ১৯৫১ সালে যারা আসামের বংশোদ্ভূত বলে চিহ্নিত হবেন, তাদের এই আওতায় আনা হবে। বাদ পড়বেন ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যারা ভারতে এসেছিলেন তারা। কেন্দ্র এ ব্যাপারে একটি কমিটি তৈরি করেছে। ওই কমিটি ভূমির অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সাংস্কৃতিক সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে সুপারিশ করবে। (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অবলম্বনে)

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *