৬৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, একটা সময় দেশের অধিকাংশ মানুষ মারা যেত সংক্রামক রোগে। কিন্তু এখন সেটি নেই। তবে এখন দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় কমিউনিকেবল ডিজিজে। আর এই ৬৫ শতাংশের মধ্যে ৩০ ভাগ মানুষের মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। এখন এটি প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে সঙ্গে যুবক ও কিশোরদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।

রোববার (১৫ ডিসেম্বর) বেলা ১২টায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ ও গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে ট্রান্স ফ্যাট ও হৃদরোগের ঝুঁকি সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের মধ্যে হার্টের অসুখ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট থাকা। এর বাইরে ধূমপান, খাবারে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ব্লাড প্রেসার, কায়িক পরিশ্রম কম করা, পরিবেশ দূষণও অন্যতম কারণ। এখন আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে কোন কোন খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট থাকে। সেসব খাবার পরিহার করতে হবে এবং ট্রান্স ফ্যাটমুক্ত খাবারগুলো গ্রহণ করতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয় উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এই কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য, কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় জড়িত। তাই সবার সমন্বয়ে এটি মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে চরম উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোর শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিছুদিন আগেই ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আটটি বিভাগে কিডনি হাসপাতাল করা হবে। প্রতিটি বিভাগে ক্যানসার হাসপাতালের অনুমতিও পাস হয়ে গেছে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত। তিনি বলেন, হার্টের জন্য ট্রান্স ফ্যাট অনেকাংশেই ঝুঁকি বাড়ায়। এ বিষয় নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২৩ সালের মধ্যেই ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ ২ শতাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশের ৫০ শতাংশ অসুখ কমে আসবে। তাই এ বিষয়ে আলাদা আইন করার প্রয়োজন আছে বলেও আমি মনে করি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ ট্রান্স ফ্যাট গ্রহনের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সাধারণত ভাজা পোড়া ও বেকারি খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট থাকে। ভেজিটেবল অয়েলের সাথে হাইড্রেজেন যুক্ত করলে তেল জমে যায় এবং ট্রান্সফ্যাট উৎপন্ন করে। এই পারশিয়াল হাইড্রোজেনেটেড অয়েল আমাদের দেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে পরিচিত। ভাজাপোড়া খাদ্যে একই তেল উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার ব্যবহারের কারণেও খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট সৃষ্টি হয়।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, এহজন ব্যক্তির দৈনিক ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের পরিমান হওয়া উচিত মোট খাদ্যশক্তির ১শতাংশের কম, অর্থাৎ দৈনিক ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটে তা হতে হবে ২.২ গ্রামেরও কম।

কর্মশালায় বলা হয়, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ডেনমার্ক ২০০৩ সালে আইন করে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ করে। অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ইরান, ভারতসহ মোট ২৮টি দেশে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ কার্যকর করায় এসব দেশে ইতোমধ্যে শিল্পোৎপাদিত খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া আরও ২৪টি দেশ ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক করেছে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে কার্যকর হবে বলেও বক্তারা জানান।

থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস অসম্পৃক্ত চর্বির উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ভারতে ২০১১ সাল থেকে তেল ও ডালডা জাতীয় পণ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ২০১৫ সালে এটি ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়। ২০১৮ সালে ভারতের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি ২০২২ সালের মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে কমিয়ে আনার পাশাপাশি খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট পরিহার করার ঘোষণাও দিয়েছে।

বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো আইন বা উদ্যোগ না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।

বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টারস ফোরামের সভাপতি তৌফিক মারুফের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের ইপিমেডিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের বাংলাদেশ কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর মুহাম্মদ রুহুল উদ্দিন এবং প্রজ্ঞা’র ট্রান্স ফ্যাট বিষয়ক প্রকল্পের টিমলিডার মো. হাসির শাহরিয়ার।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব) আব্দুল মালিকের সভাপতিত্বে এ আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রীনা পারভীন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেনপুর, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান, ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *